সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:২১ পূর্বাহ্ন
বিশেষ প্রতিনিধি: গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার আন্তর্জাতিক রামসার সাইট ও জীববৈচিত্রের অনন্য জলাধার টাংগুয়ার হাওরে অতিথি পাখির আগমন কম ঘটেছে। তবে সাইবেরিয়াসহ শীতপ্রধান দেশগুলো থেকে বরাবরের মতো এবারও কিছু পাখি এসেছে। এসব পাখি হাওরের বিস্তৃত জলরাশিতে জলকেলি ও বিশাল আকাশে উড়াউড়ি করে পাশের মেঘালয় সীমান্ত থেকেও ঢু মারে ভিন্নরকম আবহ তৈরি করেছে নীলাভ হাওরে। তবে সংশ্লি¬ষ্টরা জানিয়েছেন, এবার হাওরে কি পরিমাণ অতিথি পাখি এসেছে তা জানা যাবে বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের জরিপ দল আসলে। ওই দলটি বর্তমানে হাকালুকি হাওরে পাখির জরিপ করছে।
এলাকাবাসী জানান, হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে বছরের বেশির ভাগ সময়ই দেশিয় নানা জাতের পাখি ডানা ওড়ে হাওরে। তারা জানিয়েছেন, হাওরের পাখির অভয়াশ্রম খ্যাত লেচুয়ামারা ও বেরবেরিয়া বিলে দর্শণার্থীদের ব্যাপক আনাগোনার কারণে এই জলাশয়গুলোতে পাখির আগমন কমেছে। তবে হাওরের তুলনামূলক নীরব ও দুর্গম জলাশয় তেকুইন্যা, চটাইন্যা ও নোয়াল জলাশয়ে পাখির কিচিরমিচির লক্ষণীয়। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে হাওরে পাখির আগমন তুলনামূলক কিছু বেড়েছে বলে দর্শণার্থী ও স্থানীয় লোকজন জানান। তবে টাংগুয়ার হাওরের সঙ্গে সংশ্লি¬ষ্টরা জানান, পানি কমে আসলে পাখির মিছিল হাতিরগাতা বিল সংলগ্ন বেরবেরিয়া বিলে চলে যাবে। পাকিস্তান আমলে সুনামগঞ্জের তৎকালীন এসডিও এই বিলে পাখির অভয়াশ্রম করেছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।
টাংগুয়ার হাওর রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠন আইইউসিএন সূত্রে জানা গেছে, হাওরের লেচুয়ামরা, বেরবেরিয়া, রৌয়া, হাতিরগাতা, রূপাভূই, চটাইন্না বিলসহ হাওরের এই ছয়টি জলাধারেই বরাবর পরিযায়ী পাখিরা এসে আশ্রয় নেয়। তাছাড়া এসব জলাশয়ে বছরের বেশিরভাগ সময়ই দেশিয় নানা প্রজাতির পাখি অবস্থান করে। কালেম, পানকৌড়ি, লেইঞ্জা, বালিহাঁস, ভূতিহাঁস, পিয়ংহাঁস, খয়রাবগা, লেঞ্জাহাঁস, নেউপিপি, সরালি, রাজসরালি, চখাচখি, পাতি মাছরাঙা, পাকড়া মাছরাঙাসহ নানান প্রজাতির পাখি নীল হাওরের বিস্তৃত বুকে দলবেঁধে পাখা মেলে ওড়ছে।
হাওরে ডানা মেলা সারি সারি হিজল-করচের বাগ, গহীন নলখাগড়ার বাগে বসে কিচির মিচির ধ্বনিতে মাতিয়ে তোলে হাওর। একই সঙ্গে বিলের বুকে বসে মনের আনন্দে ডুবসাঁতার খেলছে। এ-ওর মুখে তোলে মনে আনন্দে তোলে দেয় খাবার। অতিথি পাখির এই মনোরম দৃশ্য কিছুটা এখন দেখা যাচ্ছে টাংগুয়ার হাওরের একাধিক জলাশয়ে। ডানার ওড়ালে মাতিয়ে রাখছে হাওর।
টাংগুয়ার হাওর রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও স্থানীয় লোকজন জানান, আয়তন ও গভীরতায় টাংগুয়ার হাওরের সবচেয়ে অন্যতম বড় বিল রৌয়া, বেরবেরিয়া, হাতিরগাতা, লেচুয়ামারা, রূপাভূই ও চটাইন্না বিল। লেচুয়ামারা ও বেরবেরিয়া বিল দুটি পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে স্বীকৃত হলেও এখন সাধারণ দর্শনার্থীদের চাপ বেশি এখানে। ফলে অন্যান্য নীরব জলাশয়ে পাখি চলে যাচ্ছে। তবে এখানেও কিছু পাখি উড়াউড়ি করে। অন্যান্য বছর এই সময়ে প্রচুর অতিথি পাখির আগমন ঘটলেও সেই তুলনায় এবার টাংগুয়ার হাওরে এক তৃতীয়াংশ পাখির আগমন ঘটেনি বলে এলাকাবাসি জানিয়েছেন।
টাংগুয়ার হাওরের বিভিন্ন জলাশয়ে দেখা গেছে, শরীর ও গলা ডুবিয়ে মনের আনন্দে খেলছে নানা প্রজাতির পাখি। বিরলপ্রায় পাখি কোড়া, রামকোড়া, হটা, রামহটা, ল্যাঞ্জা হাঁস, নীলমাথা হাঁস, টিকিহাঁস, বালিহাঁস, সরালি, রাজসরালি, পাতি মাছরাঙ্গা, পাকড়া মাছরাঙা, চখাচখি রামদোলাসহ হরকে রকম পাখি ডানা মেলে উড়াউড়ি করছে। টাংগুয়ার হাওরে পাখির নিরাপদ আবাসের জন্য কাজ করেছে স্থানীয় বেসরকারি সংগঠন ইরা। এই সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে শীত মওসুমে প্রতি বছর পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে টাংগুয়ার হাওরে। এই হাওরের দীর্ঘ হিজল কড়চ বাগ, কান্দা-জলাবন এবং বিস্তৃত নীল জলরাশি এসব পাখির বিস্তৃত বিচরণ ক্ষেত্র। জীব-বৈচিত্র, গহীন জলাবনের কারণে অনন্য এই জলাশয়ে যুগ যুগ ধরে অতিথি পাখিরা তাদের নিরাপদ আবাস হিসেবে বেছে নিয়েছে হাওরটিকে। এই হাওরে বিরলপ্রায় প্যালাসিস ঈগলও রয়েছে। ওই সংগঠন সূত্রে আরো জানা গেছে, কালেম পাখির দেখা মিলে যে স্থানে নলখাগড়া রয়েছে সেখানে। তাছাড়া হাঁসজাতীয় পাখি বেরবেরিয়া ও হাতিরগাতা বিলে দেখা যায়।
আইইউসিএন জানিয়েছে, বিশ্ব ঐতিহ্য টাংগুয়ার হাওরে ২১৯ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এরমধ্যে ৯৮ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি, ১২১ প্রজাতির দেশি পাখি। ২২ প্রজাতির পরিযায়ী হাঁসও রয়েছে। জানা গেছে, ২০১১ সালে এক জরিপে টাংগুয়ার হাওরে ৬৪ হাজার পাখির জরিপ স¤পন্ন হয়। জরিপে ৮৬ জাতের দেশি এবং ৮৩ জাতের বিদেশি পাখি ছিল বলে উল্লে¬খ করা হয়। গত বছর ৭০ প্রজাতির প্রায় দুই লাখের কাছাকাছি অতিথি পাখির আগমন ঘটেছিল বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। আইইউসিএন জানিয়েছে, অতিথি পাখির ব্যাপক আগমন না ঘটলেও এখন বিভিন্ন জলাশয়ে বেগুনি কালেম, ডাহুক, পান মুরগী, সরালি, রাজসরালি, পাতিমাছরাঙা, পাকড়া মাছরাঙা ও চখাচখি, রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড (লাল ঝুটি), পিন টেনল (ল্যাঞ্জা হাঁস), সভেলার (খুন্তে হাঁস), মালার্ড (নীলমাথা হাঁস), পিয়াং হাঁস (গাডওয়াল), ঠাফটেউ (টিকিহাঁস), কঁনপিগমি (ধলা-বালিহাঁস) দেখা গেছে।
টাংগুয়ার হাওরপাড়ের গ্রাম সোলেমানপুরের আবুল খায়ের বলেন, টাংগুয়ার হাওরে এবার অতিথি পাখি কমছে। তবে দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিদিনই লোকজন আসছে পাখি দেখতে। হাওরে আগের তুলনায় বন-জঙ্গল কম থাকায় পাখির আগমন কমছে। তাছাড়া চোরাই শিকারী ও পর্যটকদের উৎপাতের কারণেও পাখির আগমন কমেছে।
টাংগুয়ার হাওরে পাখির নিরাপদ আবাস নিয়ে কাজ করছে স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠন ইরা। এই সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, শুধু অতিথি পাখিই নয়, টাংগুয়ার হাওরের অনন্য জীববৈচিত্রের কারণেই পাখিরা নিরাপদ আবাসের জন্য বেছে নিয়েছে। কিন্তু নানা কারণে পাখির সেই প্রাকৃতিক আবাস ধ্বংস হচ্ছে। ফলে হাওরে অতিথি পাখির আগমন কমছে। তবে স্থানীয় পাখিসহ কিছু অতিথি পাখি এখন হাওরের জলাশয় ছাড়াও টাংগুয়ার হাওরের বিভিন্ন দুর্গম গ্রামের কান্দা, বাগানে আশ্রয় নিচ্ছে। সেসব স্থানে অনেক পাখি দেখতে পাওয়া যায়। আমরা পাখির নিরাপদ আবাস গড়ে তোলতে স্থানীয়দের নিয়ে কাজ করছি।